২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘অচল’ শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে ঢাকা

-

রাজধানী শহর ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ছে। খোঁড়াখুঁড়ি, কাটাকুটি, নতুন নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতার ফলে রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এসব রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই কাটাতে হচ্ছে নিরুপায় কর্মজীবী মানুষকে। এই দুর্ভোগ এক দিন, সপ্তাহ বা মাসের নয়। এ অবস্থা চলছে মাসের পর মাস। ১০ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, যা বর্তমানে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এ গতি ঘণ্টায় চার কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে। তার মানে যানবাহনের চেয়ে হেঁটেই গন্তব্য পৌঁছানো যায় আগে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী মেগা সিটি ঢাকা শহরের জনসংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ, যা ২০৩৫ সালে দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে তিন কোটিতে দাঁড়াবে। এত ঘনবসতিপূর্ণ শহরে নাগরিকের জরুরি প্রয়োজন মেটানো চারটিখানি কথা নয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে আক্ষরিক অর্থেই একটি ‘অচল’ শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে।
নগর কর্তৃপক্ষ অথবা সরকারের কোনো পর্যায় থেকেই এই দুর্ভোগ নিরসন কিংবা নিদেনপক্ষে কমিয়ে আনার মতো কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে নগরবাসী অসহায়, নিরুপায়। দুর্ভোগ থেকে শিগগিরই মুক্তির কোনো পথ তাদের সামনে খোলা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সাময়িক স্বস্তির কোনো পথ দেখাতে পারছে না।
ঢাকার শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, জলাবদ্ধতা, মশা ও মশাবাহিত রোগ, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, ধোঁয়া, ধুলো, ডাস্টবিনের উপচে পড়া ময়লা, ভেজাল খাবার, হাঁটা ও বিনোদনের জায়গার অভাব ইত্যাদি আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত সমস্যা দিন দিন বাড়ছেই। যানজট নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণে গত এক দশকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। তারপরও কেন যানজট বেড়েই চলেছে? এ প্রশ্নে পরিবহন বিশেষজ্ঞদের সবার উত্তর, সড়কের স্বল্পতা, দুর্বল গণপরিবহন ব্যবস্থা, মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার, সড়কে অবৈধ দখল-পার্কিং ও পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা যানজটের জন্য দায়ী।
ঢাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ ও সমন্বয়হীনতাও যানজটের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এতে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, যানজট নিরসনে নগরীতে দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এবং পুলিশ কাজ করে, কিন্তু এই চার সংস্থার মধ্যেও সমন্বয় নেই। ঢাকায় কখনো গণপরিবহনকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ‘দৃশ্যমান উন্নয়ন’-এর ভ্রান্ত পরিকল্পনায় একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। সারা বিশ্বে বাস, সাইকেল, হেঁটে চলাকে গুরুত্ব দেয়া হয় কিন্তু বাংলাদেশে প্রাধান্য দেয়া হয় প্রাইভেট কারবান্ধব ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে।
ডেমোক্র্যাটিক ইন্টারন্যাশনালের ফেলোশিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সড়কের ৭৬ শতাংশ থাকে প্রাইভেট গাড়ির দখলে। কিন্তু এসব গাড়ির যাত্রী মাত্র ৬ শতাংশ। বাকি ২৪ শতাংশ সড়ক ব্যবহারের সুযোগ ৯৪ শতাংশ যাত্রীর। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ এখনো কার্যকর হয়নি। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১৭ সালে ঢাকায় দৈনিক গড়ে ৫৩টি প্রাইভেট কার নিবন্ধিত হয়েছে। একই বছরে প্রতিদিন রাস্তায় নতুন যানবাহন নেমেছে ৩৮৩টি। যানজট, জলাবদ্ধতার মতো সঙ্কটের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেও ঢাকায় বেড়েছে ভূমিকম্প ও বন্যার ঝুঁকি। ৩৫ লাখ বস্তিবাসী প্রায়ই বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম সুবিধা থেকেও। ১৯৯৫ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে এই শহরে জনসংখ্যা বেড়েছে ৫০ শতাংশ আর যান চলাচল বেড়েছে ১৩৪ শতাংশ, অথচ শহরে সড়ক বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জিপজেটের তালিকা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে মানসিক চাপের শহর। এতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, মানসিক চাপ সৃষ্টির অসংখ্য উপাদান ঢাকা শহরে বিদ্যমান। দিনে দিনে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বাড়ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি এসবের দামও দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ বিশ্বে দ্রুত ধনী হওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে স্থান করে নিয়েছে। তার মানে প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগ চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক ধনী ব্যক্তির হাতে আর গরিব আরো গরিব হচ্ছে।
বিভিন্ন অনাচার, অবিচার ও অপরাধের কোনো সুরাহা নাগরিকেরা পাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, বিচারালয় কোথাও তেমন প্রতিকার পাবে, তেমন বিশ্বাস নাগরিকদের মধ্যে নেই। তাই ডিপ্রেশন, অবসাদ ও হতাশা বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা: মো: তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আমাদের ব্রেইনে রয়েছে একটি স্বয়ংক্রিয় নার্ভাস সিস্টেম। এটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছেÑ ‘প্যারাসিমপ্যাথেটিক, যা আমাদের শরীর-মনকে শান্ত, স্থির রাখতে সাহায্য করে। অন্যটি হচ্ছেÑ ‘সিমপ্যাথেটিক’ বিভাগ, যা আমাদের উত্তেজিত করে, জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করে। এর জন্য প্রচুর শক্তি-সামর্থ্য একত্রে জড়ো করতে হয়। মানসিক চাপ আমাদের সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সব সময় সক্রিয়, সজাগ ও উত্তেজিত করে রাখে। এর ফলে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিরক্তি, রাগ, ক্রোধ, আগ্রাসী আচরণ যেমন দেখা দিতে পারে, তেমনি পরবর্তী সময়ে ডিপ্রেশন বা অবসাদ, হতাশা, হাল ছেড়ে দেয়া, অকেজো মানুষ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সর্বোপরি চাপ যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন শরীর অনবরত শক্তি জড়ো করতে থাকে এবং সে শক্তি অহেতুক ক্ষয় হতে থাকে। এভাবে ক্রমাগত শক্তি ক্ষয়ের ফলে শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রের গঠনকাঠামোতেও পরিবর্তন সাধিত হয়। মানসিক চাপ-পীড়ন এভাবে বিভিন্ন শারীরিক রোগও সৃষ্টি করে থাকে, যাকে আমরা ‘সাইকো-সোমাটিক ডিসঅর্ডার’ বলি। আমাদেরও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য, স্বস্তিযোগ্য, নিরাপদ ও নান্দনিক ঢাকা শহর গড়ে তোলার জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মপরিকল্পনা এখনই হাতে নিতে হবে। সময় নষ্ট করার মতো সময় আমাদের নেই।
নগর-গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং অর্থহীন ও উল্টাপাল্টা প্রকল্প গ্রহণের ফলে নগরীর এ অচলাবস্থা। পরিস্থিতি ইতোমধ্যে খুব খারাপ হয়ে গেছে। ঢাকায় নতুন সমস্যা হিসেবে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য। এখনকার মতো আর কিছু দিন চলতে থাকলে ঢাকা পুরোপুরি ‘ফেইলড সিটি’ হয়ে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement